ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১লা ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

“মু’মিন ব্যক্তি মিথ্যা বলতে পারে না” মুফতী মাসুম বিল্লাহ নাফিয়ী

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ সোবহানাহু তা’য়ালার জন্য যিনি আলম সমূহের প্রতিপালক এবং দরুদ- সালাম  নূরনবী হযরতের ওপর যিনি কুলকাইয়্যেনাতের রহমত মানবতার মুক্তির দূত ও পরপারের শাফায়াতের অধিকার প্রাপ্ত।আলোচ্য বিষয় “মিথ্যা বলা মু’মিনের কাজ নয়”মিথ্যা বলা কোনো ক্ষেত্রেই অনুমোদিত নয়। এছাড়াও মিথ্যা বলা অশোভনীয় ও অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ। মিথ্যা ভয়াবহ গুনাহ। মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকতে ইসলাম দৃঢ়ভাবে মু’মিনদের সতর্ক করেছে। শরিয়তে সত্যকে সর্বত্রই উৎসাহিত করা হয়েছে। প্রকাশ আছে যে, সত্য মুক্তি দেয়, মিথ্যা ধ্বংস আনে। সামাজিক আচরণবিধি সম্পর্কিত মাসয়ালা পাওয়া যায় বিবদমান দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং নির্দোষ ব্যক্তির প্রাণ রক্ষার লক্ষ্যে কখনো অপ্রিয় সত্যটি গোপন করা বা অসত্যকে তুলে ধরার শরীয়তের বিধানে অনুমতি রয়েছে। কোনো বৈধ বিষয়কে প্রতিষ্ঠিত করতে বা অধিকার সুরক্ষার জন্য দ্ব্যর্থবোধক বা অস্পষ্ট কথা বলার অনুমতি শরিয়তে রয়েছে। তবে যে কোনো পরিস্থিতিতে সত্য বলাই শরিয়তের মুল দর্শনের দাবি ও তাকওয়াপূর্ণ।
চারিত্রিক স্খলনের কারণে অনেকে মিথ্যায় জড়িয়ে যায়। মনুষ্যত্ববোধ ও রুচিশীলতা লোপ পেলেও অনেকে মিথ্যার বেসাতি তৈরি করে থাকে। কিন্তু সুস্থ ও সঠিক মন-মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ ব্যক্তি কোনোক্রমেই মিথ্যা বলা দূরের কথা মিথ্যা কথাকে সমর্থনও দিতে পারে না।
মিথ্যাবাদীর পরিণাম দুনিয়া ও আখেরাতে খুবই নিন্দনীয়। তবে নির্দিষ্ট কয়েকটি ক্ষেত্রে ও মৌলিক স্বার্থে ইসলামে মিথ্যা বলার অবকাশ রয়েছে। যেমন ১। যুদ্ধে কৌশলের গোপনীয়তায় মিথ্যা বলা বৈধ,২।দু’পক্ষের মাঝে সমঝোতা করার জন্য মিথ্যা বলা বৈধ,৩।স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা ও মিল তৈরির করার জন্যও মিথ্যা বলা বৈধ।
আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন, ‘মিথ্যা তো তারাই বানায়, যারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের ওপর ঈমান রাখে না। বস্তুত তারাই মিথ্যুক।(সুরা নাহাল, আয়াত-১০৫)
আবু হুরায়রা রাঃথেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল সাঃ বলেন, মুনাফেকদের নিদর্শন তিনটি : কথা বলার সময় মিথ্যা বলা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা এবং আমানতের খেয়ানত করা। (বুখারি, হাদিস নং ৩৩, মুসলিম, হাদিস নং ৫৯)
মুসলিম মনীষীরা বলেছেন, সবচেয়ে বড় মিথ্যা হলো আল্লাহ ও তার রাসুল সাঃ এর ওপর মিথ্যারোপ করা। এর শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ। কেউ কেউ এ জাতীয় মিথ্যুককে কাফের পর্যন্ত বলেছেন। আল্লাহ ইরশাদ করেন, আর তোমাদের জিহ্বা দ্বারা বানানো মিথ্যার ওপর নির্ভর করে বলো না যে, এটা হালাল এবং এটা হারাম, আল্লাহর ওপর মিথ্যা রটানোর জন্য। নিশ্চয় যারা আল্লাহর নামে মিথ্যা রটায়, তারা সফল হবে না।  (সুরা নাহাল, আয়াত -১১৬)
আলী রাঃথেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, তোমরা আমার ওপর মিথ্যা বলবে না, যে আমার ওপর মিথ্যা বলবে, সে যেন জাহান্নামে প্রবেশ করে। (বুখারি, হাদিস নং ১০৬)
ইবনুল কায়্যিম রহঃবলেন, এর অর্থ হচ্ছে যে রাসূল সাঃ এর ওপর মিথ্যা বলবে সে যেন নিজ স্থায়ী ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়। (তারিকুল হিজরাতাইন-১৬৯)
আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন, হে মু’মিনরা! তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সঙ্গে সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে সদা দণ্ডায়মান হও। কোনো কওমের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদেরকে কোনোভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ইনসাফ করবে না। তোমরা ইনসাফ করো, তা তাকওয়ার নিকটতর। (সুরা মায়েদা, আয়াত-৮)
ইমাম নববি রহঃ বলেন, এ সব হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, যা যা শোনা যায় তার সব কিছু বলা নিষেধ। কারণ, প্রতিনিয়ত সত্য-মিথ্যা অনেক কিছুই শোনা যায়, অতএব যে ব্যক্তি সব কিছু বলে বেড়াবে—তার দ্বারা মিথ্যা প্রচারিত হওয়াই স্বাভাবিক, যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। আর এটাই হচ্ছে মিথ্যা, মিথ্যার জন্য ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো দখল নেই। হ্যাঁ, গোনাহগার হওয়ার ইচ্ছা শর্ত। আল্লাই ভাল জানেন। (শরহু মুসলিম -১/৭৫)
উম্মে কুলসুম রাঃ বলেন, আমি রাসুল সাঃ কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি দুই জনের মাঝে সমঝোতা করার জন্য ভালো কথার আদান-প্রদানকালে মিথ্যা বলে—সে মিথ্যুক নয়। (বুখারি, হাদিস নং ২৫৪৬, মুসলিম, হাদিস নং ২৬০৫)
আসমা বিনতে ইয়াজিদ বলেন, রাসুল সাঃ বলেছেন, ‘তিন জায়গা ব্যতীত মিথ্যা বলা বৈধ নয়। স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার জন্য মিথ্যা বলা, যুদ্ধে মিথ্যা বলা এবং দু’জনের মাঝে সমঝোতা করার জন্য মিথ্যা বলা বৈধ। (তিরমিজি, হাদিস নং ১৯৩৯; সহিহ আল-জামে -৭৭২৩)
“মু’মিন ব্যক্তি মিথ্যা বলতে পারেনা”যে বা যারা মিথ্যা বলো সে বা তারা নিঃসন্দেহে ফাসেক।উল্লেখ্য কওমী হেফাজতীনেতা মামুনুল হক কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে তার দ্বারায় সংগঠিত ঘটনার পেইজের লাইভে বক্তিতায় সার্বিক পরিস্থিতি ও অবস্থার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মিথ্যার বলার ব্যাপারে ইসলামের বিধিবিধানের অপব্যাখ্যা করে যে সীমালঙ্ঘন করলো। উপরে উল্লেখিত দলিল মতে প্রমাণিত হয় যে, সে একজন প্রতারক ও ধোঁকাবাজ, চরম মিথ্যাবাদী এবং ফাসেক। এ বক্তিতার পর ইসলাম নিয়ে কথা বলার তার কোন নৈতিক অধিকার নাই। যে শয়তানের অনুসারী হয়ে নফসের তারণায় অপকর্ম লিপ্ত হয় এবং অপকর্ম বৈধ করার অপচেষ্টায় ইসলামের অপব্যাখ্যা করে। সে নিঃসন্দেহে জালেম ও পথভ্রষ্ঠ। সুতরাং দেশপ্রেমিক জনতা এপ্রতারকের বিভ্রান্তিমূলক কথার দিকে কান না দিয়ে ইসলামের মৌলিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঈমান আকিদা সুরক্ষায় ব্রতী হবেন বলে প্রত্যাশা করি-ফি-আমানিল্লাহ।