ঢাকা, বুধবার, ১৮ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আস্তাবলে জোটে না খাবার, সৈকতে শীর্ণ ঘোড়া

চট্টগ্রাম: পতেঙ্গা সৈকতে ঘুরতে আসা মানুষকে ঘোড়ায় চড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে পিছু নেওয়া সহিসরা যতটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তার চেয়ে বেশি দৃষ্টি যায় শীর্ণ-ক্লান্ত ঘোড়াগুলোর দিকে। ক্ষত লুকাতে পিঠের ওপর দেওয়া রঙিন কাপড়ের বালিশ দেখে আরোহী জানতেই পারেন না প্রাণিগুলোর দিনযাপনের খবর।

বিভিন্ন উৎসব, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান, বিয়ে, জন্মদিন, চলচ্চিত্রের দৃশ্যধারণ, র‌্যালিতে ব্যবহার করা হয় ঘোড়াসমেত গাড়ি। আবার কখনও গণপরিবহন চলাচল বন্ধ থাকলে ঘোড়ার গাড়ি রাস্তায় নামে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে।

মানুষ আনন্দ পেলেও এই ঘোড়াগুলোর জীবন বর্ণহীন। ঠিকমতো দেওয়া হয় না খাবার। নেওয়া হয় না যত্ন। অথচ পরিশ্রম করানো হয় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। কাজ শেষে রাখা হয় অপরিচ্ছন্ন আস্তাবলে। নগরের সাগরিকা রোডে রেললাইনের পাশের খামারে দেখা মেলে এমন চিত্র।

এখানকার ঘোড়ার মালিক পিরোজপুরের বাসিন্দা মো. আবদুল, মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ও মোহাম্মদ মামুনের আছে ১০টি ঘোড়া। তারা জানান, একটি ঘোড়াকে দৈনিক ৮ থেকে ১০ কেজি খাবার দিতে হয়। কিন্তু প্রতিদিন বার্লি, ঘাস ও গমের ভুষি দিতে হিমশিম খেতে হয়। আয় কমে যাওয়ায় ৪-৫ কেজি খাবারও দেওয়া যাচ্ছে না। এতে রোগাক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে ঘোড়াগুলো।

তারা বলেন, প্রতিমাসে ঘোড়াগুলো রাখার জন্য তিন হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। আগে সপ্তাহে ৪-৫ দিন অনুষ্ঠান থাকতো। এখন সপ্তাহে একটি অনুষ্ঠানের ডাকও আসে না। সৈকতে পাঠিয়েও তেমন টাকা আয় হয় না।

পতেঙ্গা সৈকতে কথা হয় ঘোড়ার সহিস মোহাম্মদ ফয়সাল (২৯) এর সঙ্গে। সে জানায়, উত্তর কাট্টলি থেকে পতেঙ্গা এলাকায় ঘোড়া নিয়ে ঘুরি আমরা ৯ জন। আগে বিয়েবাড়িতে বর-কনেকে ঘোরানো, নানা অনুষ্ঠানে গিয়ে ঘোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে এবং পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ও রাসমনি ঘাট, ফয়’স লেক এলাকায় পর্যটকদের চড়ানোর মাধ্যমে ভালো আয় হতো। এখন হয় না।

আরেক ঘোড়ার সহিস জসিম (২৭) জানায়, তার মালিকের ২টি ঘোড়া আছে। একটি দিয়ে পর্যটকদের চড়ানোর পর আয়ের টাকা মালিককে বুঝিয়ে দিতে হয়। আয়ের ওপর নির্ভর করে সে পায় পারিশ্রমিক।

এই সহিস যখন কথা বলছিল তখন ঘোড়াটি ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হয়ে উঠছিল। ভেসে উঠেছে শরীরের সবগুলো হাড়। দেখা গেছে, দাঁড়িয়ে থাকা ঘোড়ার শরীরে রোগ বাসা বেঁধেছে। গলায় দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। দড়ির নিচের চামড়ায় কালচে দাগ। শরীরে আছে ক্ষতচিহ্ন। চর্মরোগের শিকার কয়েকটি ঘোড়া।

সৈকতে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়লেও শীর্ণ ঘোড়ার পিঠে উঠে বেড়ানোতে কেউ তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। রাশেদ নামের এক কিশোর জানায়, গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকলে তার ঘোড়ার গাড়িতে টাইগারপাস থেকে যাত্রী নিয়ে নিউ মার্কেট পৌঁছে দেওয়া হয় জনপ্রতি ২০ টাকা ভাড়ায়। সৈকতে ঘোড়ায় চড়লে একজনকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ৫০ টাকা দিতে হয়।

তবে ঘোড়ায় চড়তে প্রলুব্ধ করার পর শিশু-কিশোর কিংবা বড়দের ঘোড়ার পিঠে তুলে চড়ানোর পর কেউ কেউ ৪শ-৫শ টাকা চেয়ে বসে। এ নিয়ে বাগবিতণ্ডাও চলে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের মদদে চলে এই ব্যবসা। তাদের কথামতো টাকা না দিলে লাঞ্ছিত হতে হয় বলে অভিযোগ করেছেন কয়েকজন পর্যটক।

সম্প্রতি নগরের আমবাগান মাঠে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে থাকা একটি ঘোড়াটি উদ্ধার করে অ্যানিমেল কেয়ার অব চট্টগ্রামের (এসিসি) সদস্যরা। ডান পায়ে ক্ষত থাকায় ঘোড়াটি দাঁড়াতে পারছিল না। ১০ দিন ধরে একই জায়গায় ঘোড়াটি পড়ে থাকার পরও মালিক শেখ সেলিম চিকিৎসার ব্যবস্থা করেননি।

এসিসির সদস্যরা জানান, উদ্ধারের ১০ দিন আগে অন্য ঘোড়ার সঙ্গে মারামারি করে বড় একটি স্যুয়ারেজে পড়ে যায়  ঘোড়াটি। এতে  পায়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়। মালিক তাকে মাঠে রেখে যায়। ঘোড়াটি উদ্ধার করে ভ্যান গাড়িতে করে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে সেটিকে শেল্টার হোমে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকরা বলেছেন, গাড়ি টানতে টানতে ঘোড়াটির মেরুদণ্ড ক্ষয় হয়েছে। বয়সের ভারে শারীরিক অবস্থাও দুর্বল।

পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে প্রয়লংকরী ঘূর্ণিঝড় আম্পানের রাতে একটি ঘোড়া বাইরে রাখা মালিকের সন্ধান পায় চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। পরে ঘোড়াটি উদ্ধার করার জন্য একটি টিম গেলে বাধা দেন ঘোড়ার মালিক মো. শেখ ফরিদ।

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ডেপুটি কিউরেটর ডা. শাহাদাত হোসেন শুভ বলেন, পতেঙ্গার আশপাশের বেশিরভাগ ঘোড়া রাতের বেলা ছাড়া অবস্থায় থাকে। প্রায় সবগুলো রোগা। বেশিরভাগ ঘোড়া পরিমাণ মতো খাবার পায় না।  অতিরিক্ত পিঠে চড়া ও অপুষ্টির কারণে ঘোড়াগুলো রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে।

তিনি জানান, ঘোড়া যখন পর্যটক বা ভার বহন করতে অক্ষম হয়ে পড়ে তখন মালিকের কাছে সেটি মূল্যহীন। বেশিরভাগ ঘোড়া না খেয়ে ও বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় যেসব ঘোড়া আছে সবগুলোই কুড়িয়ে পাওয়া পরিত্যক্ত ঘোড়া। ভাল ও সুস্থ ঘোড়া কেউ দেয় না।

প্রাণিবিদ্যার শিক্ষক মো. জয়নাল আবেদীন  বলেন, ‘একটি পরিশ্রমী ঘোড়াকে প্রতিদিন তার ওজনের ৬ থেকে ৮ শতাংশ প্রোটিন খাওয়াতে হয়। ছোলা, ভুট্টা, গম ও যবের মধ্যে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি। পাশাপাশি টমটম বা গাড়ির ঘোড়াগুলোকে ১৫ দিন অন্তর চিকিৎসা করানো দরকার। কারণ এদের পরিশ্রম বেশি। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। যা অমানবিক ও বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা আইন-২০১২ অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ’।