*ভয়াল ২৫ মার্চ, ১৯৭১* অনলাইন সংস্করণ – ১৩ ( ৬৫ থেকে ৬৮ পৃষ্ঠা)
দেখতে দেখতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই ভয়াল কালোরাত নেমে এল। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাঙালিদের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে দানবীয় শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর। ২৫ মার্চের ওই ভয়াল রাতের কথা স্মরণ হলে এখনো গা শিউরে ওঠে। রাত তখন ১১টা। আমরা যে কয়জন লক্ষ্মীবাজারের মেসে আছি, বসে বসে দেশের কথা আলোচনা করছি। তখন হরতাল, অবরোধের কারণে ট্রেন চলাচল একরকম বন্ধই ছিল। তাই আমরা নর্থবেঙ্গলের ছেলেরা, কে কোন পথে বাড়ি যাবো সে সব বিষয়ে শলাপরামর্শ করছি। এমন সময় গুলির শব্দ, একের পর এক গুলির আওয়াজে কান ফেটে যাওয়ার অবস্থা। সবাই মিলে চারতলার ছাদে গিয়ে দেখলাম ঢাকার আকাশ তখন ছেয়ে আছে অসংখ্য আগুনের ফুলকিতে। এ অবস্থায় ছাদে টিকতে না পেরে যে যার মতো নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলাম। সারারাত অবিরাম গোলাগুলির আওয়াজে ঘুম আসলো না আমাদের।
সকাল হতেই আমরা সাত সতীর্থ পড়ি কি মরি করে তল্পিতল্পা গুটিয়ে পায়ে হেঁটে ফুলবাড়িয়া পুরাতন রেল স্টেশন হয়ে কমলাপুর রেল স্টেশনে যাই । (গুলিস্তানের পিছনে এখন যেখানে অনেক বহুতল ভবনের সারি, সেখানেই ছিল ঢাকার প্রধান রেলস্টেশন)। ষ্টেশনে যেতে পথে পথে লাশের পর লাশ দেখলাম। ছিন্নভিন্ন হাত-পা আর গুলিতে বা কামানের গোলায় ঝাঁঝড়া হয়ে যাওয়া বা দলা পাকানো মানুষের রক্তাক্ত দেহ, এলোমেলো আর বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এখানে-সেখানে। পাকিস্তানীদের এই নৃশংসতা আর বর্বরতা দেখতে দেখতে আমরা ভয়ে সিটিয়ে গেলাম। স্টেশনের পথে হনহন করে হাঁটছি আর ভাবছি রাস্তায় পড়ে থাকা নিথর এই মানুষগুলো সন্ধ্যারাতেও জীবিত ছিল, কেউ চা খাচ্ছিল, কেউ বা কাজকর্ম শেষে বাড়ি ফিরছিল কেউবা আবার ঘুমিয়ে ছিল। পাকিস্তানী হায়েনারা এই নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষগুলোকেও রেহাই দেয়নি। ভয়ে ভয়ে সারা রাস্তা হেঁটে স্টেশনে গিয়ে দেখি ট্রেন নেই। হরতাল, অবরোধের কারণে স্বাভাবিক ট্রেন চলাচল এমনিতেই বিঘ্নিত হচ্ছিল।
তারপর আবার ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র মানুষের উপর পাকিস্তানী সৈন্যদের নির্বিচারে গুলিবর্ষণ সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। আমরা তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম বুড়িগঙ্গার অপর পাড়ে অর্থাৎ জিঞ্জিরার দিকে চলে যাওয়ার। এতে একদিকে যেমন নিরাপত্তা কিছুটা নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে তেমনি আমাদের বাড়ি যাওয়ার রাস্তাও বের করা সম্ভব হবে। আমরা সদরঘাট থেকে ডিঙ্গি নৌকায় করে বুড়িগঙ্গা পার হলাম। দেখলাম, শত শত মানুষ, কেউ কেউ গুলিবিদ্ধ, প্রাণ বাচানোর জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে বুড়িগঙ্গার ওপারে। আমরা জিঞ্জিরায় ছনের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট একটা হোটেলে আশ্রয় নিলাম। হোটেল মালিকের নাম আব্দুল মালেক, বাড়ি সিরাজগঞ্জ। বেশ পরোপকারী লোক বলেই তার কথাবার্তা বা আচার-আচরণে প্রমাণ পেলাম। আমাদের কারো কারো বাড়ি সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী শুনে মালেক সাহেবের বাড়তি আদর-যত্ন পেলাম। রাতে হোটেলে বসেই দাদা এবং নওগাঁয় দুলাভাইয়ের কাছে সংক্ষেপে চিঠি লিখে জানালাম, ‘আমি ভালো আছি, নিরাপদে আছি। ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছি বাড়ি পৌঁছতে কয়েকদিন সময় লাগবে।’ একরাত হোটেলে গাদাগাদি করে থাকার পরদিন সকালে বাড়ির উদ্দেশ্যে নৌকায় রওনা দিলাম আমরা সাত সতীর্থ। মালেক ভাই আমাদের একটা নৌকা ভাড়া করে দিলেন মানিকগঞ্জ পর্যন্ত, ভাড়া ১২০ টাকা। আমাদের কারোর কাছেই তেমন টাকা-পয়সা নেই। আমার যা টাকা ছিল সবই আংটি কিনে শেষ হয়েছে। আমরা সাতজন মিলে নৌকা ভাড়ার টাকা তুলে একজনের কাছে গচ্ছিত রাখলাম। আমার হাতে আছে মাত্র ২৫ টাকা। মানিকগঞ্জ যেতে সময় লাগবে দু’দিন। পথে খাওয়ার সমস্যা তো আছেই। আমরা নৌকায় উঠেই মাঝিদের সঙ্গে কথা বলে নিলাম। তাদের বললাম- ‘আমরা কিন্তু তোমাদের সঙ্গেই খাবো।’ এক মাঝি বলল- ‘খরচা দিলে খাওয়াতে আপত্তি নেই।’ জিঞ্জিরা ঘাট থেকে উজান ঠেলে নৌকা রওনা হলো মানিকগঞ্জের উদ্দেশ্যে। বুড়িগঙ্গার বুকে তখন শতশত নৌকার বহর। উজানে সব নৌকার গন্তব্য একই, মানিকগঞ্জ। প্রাণ বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে সবাই এখন ঢাকা ছাড়ছে। দুই দিন, দুই রাত শেষে আমরা মানিকগঞ্জে পৌঁছলাম। আমাদের মধ্য থেকে তিনজন নেমে গেল মানিকগঞ্জে। বাকি থাকলাম আমরা চারজন উত্তরবঙ্গের। ওখান থেকে আমাদের বিশাল যমুনা নদী পাড়ি দিতে হবে।
আমরা গ্রামের ছেলে সবাই সাঁতার জানি। মানিকগঞ্জ থেকে লঞ্চ বা নৌকায় নগরবাড়ি যাওয়া যায়। তখন এ দেশে ইঞ্জিন চালিত নৌকার প্রচলন হয়নি। অল্প পয়সায় লঞ্চে গাদাগাদি করে নগরবাড়ি গেলাম। ঘাটে নেমে দুপুরে ইলিশ মাছ দিয়ে পেট ভরে ভাত খেলাম। তখন পিছনে ফেলে আসা সব চিন্তা অনেকখানি দূর হয়ে গেছে। এখন শুধু দাদা, মা, বোনদের কথা মনে পড়ছে। আমার জন্য কত না দুঃশ্চিন্তায় আছে দাদা, মা এবং বোনেরা ।
সিরাজগঞ্জের বন্ধু হামিদ আমার সিনিয়র। খুব ভাল ছাত্র। হাতে কাপড় বোনার তাঁত আছে তাদের। আমি তাকে বললাম- ‘ভাই আমার হাতে তেমন টাকা-পয়সা নাই। আপনি যদি আমাকে কিছু টাকা দেন তা হলে খুব উপকার হয়। আমি বাড়ি গিয়ে আপনার টাকা মানিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দিব।’ তিনি বললেন- ‘তুমি আমাদের বাড়িতে চলো, দু’একদিন থাকো তারপর সব ব্যবস্থা হবে।’ আমি আশ্বস্ত হলাম। তাঁর বাড়িতে দু’দিন থাকার পর তিনি আমাকে নিয়ে সিরাজগঞ্জ স্টেশনে এসে সান্তাহারের ট্রেনে উঠিয়ে দিলেন
ট্রেনে উঠেই আমার চোখ ছানাবড়া। কামরাভর্তি পাকিস্তানী আর্মি। অমনি ট্রেন থেকে নেমে আবার হামিদ ভাইয়ের বাড়িতে ফিরে এলাম। এরপর প্রতিদিনই সিরাজগঞ্জ স্টেশনে আসি বাড়ি যাওয়ার জন্য। কিন্তু তখন সব ট্রেনেই আর্মি বোঝাই থাকতো। এই হায়েনার দল তখন বাংলার মানুষের রক্ত খাওয়ার লোভে ঢাকাসহ বিভিন্ন সেনা ছাউনী থেকে বেরিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি আরও দুই দিন হামিদ ভাইয়ের বাড়িতে থাকলাম।
তারপর একদিন সুযোগ মতো ট্রেনে চড়ে নিরাপদে সান্তাহার এসে পৌঁছলাম। সান্তাহার রেলস্টেশন থেকে রিক্সায় নওগাঁয় ফিরোজা বুবুর বাসার কাছাকাছি যেতেই দেখি, দাদা বাসার সামনের রাস্তা ধরে আমার দিকেই এগিয়ে আসছেন। আমি দেখলাম দাদা কাঁদছেন, বারবার চোখ মুছছেন, ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না। মনে হচ্ছে এই বুঝি পড়ে যাবেন। উদভ্রান্ত চেহারা। আমি রিক্সা থেকে দাদা বলে ডাক দিতেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। রিক্সা থেকে নামার পর জড়িয়ে ধরলেন এবং আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, ”আল্লাহর কাছে যা চেয়েছি তাই পেয়েছি”। দাদার কান্না দেখে আমিও উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলাম। দাদা আমাকে রিক্সায় উঠিয়ে দিয়ে বাজারের পথ ধরলেন। যাওয়ার সময় বললেন- ‘বাসায় গিয়ে বলিস আমি বাজার থেকে মাছ, মাংস, দই, মিষ্টি নিয়ে আসছি।’ আমাকে দেখে মা বুবু, দুলাভাই খুব আদর-যত্ন শুরু করে দিলেন। মনে হয় আমি যেন নতুন কোনো মেহমান এসেছি। মায়ের চোখে আনন্দ অশ্রু। শুধু আমার দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছে, কিন্তু মুখখানা খুব হাসি-খুশি। আমি ঢাকা থেকে বেঁচে ফিরেছি এটাই যেন অবাক করা বিষয় সবার কাছে। দাদা এবং মা আমার চিঠি পাওয়ার আগেই নওগাঁ এসেছিলেন। ওই দিন বুবুর বাসায় থেকে পরের দিন সকালে বাড়ি যাই। বহুদিন পর গ্রামের বন্ধুদের কাছে পেলাম। ঢাকা থেকে বাড়িতে আসার সময় যেমন কষ্ট ছিল তেমনি আনন্দও ছিল।
একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে উৎকণ্ঠা কেউ বলতে পারছে না। আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ কী? গ্রামের এবং এই অঞ্চলের গণ্যমান্য মুরুবিৱা মাঝে মাঝে আমাদের জিজ্ঞেস করেন, কী হবে দেশের অবস্থা?। আমরা বলি, জনগণ ত্যাগ স্বীকার করতে পারলেই কেবল অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে। আমাদের গ্রামের মাত্র চারজন কলেজ, বিশ্ববিদালয়ে লেখাপড়া করি। অন্যদিকে আমার স্কুল জীবনের সহপাঠিরা বেশির ভাগই বিয়ে-শাদী করে রীতিমত সংসার ধর্ম পালন করছে। আমরা এখনো পড়াশোনা করছি। এজন্য এলাকার লোকজন আমাদের খুব সম্মানের চোখে দেখতেন।