*অসুস্থ দাদাকে নিয়ে ভারতের বালুরঘাট গমন*
১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল দাদা রাতে আমাকে কাছে ডাকলো। বলল- ‘আমি আর বাঁচবো না বাবা। ইচ্ছা ছিল তোর বিয়ে দিয়ে চলে যেতে। কিন্তু আমার বড় ধরনের অসুখ। বলে আমার হাত ধরে প্রস্রাব করার জন্য বাইরে নিয়ে গেল। দাদা বলছে- ‘দেখ আমার প্রস্রাবের পরিবর্তে তাজা রক্ত পড়ছে।’
আমি দেখলাম, তাইতো, তাজা রক্ত। ভয় পেয়ে জানতে চাইলাম, ব্যথা করে কিনা? দাদা বললে- ‘না, আমাকে বিছানায় নিয়ে চল।’ ওই রাতে ভোর পর্যন্ত দাদা অন্তত ৪ বার রক্তমিশ্রিত প্রস্রাব করলো। আমি দাদার মাথার কাছে বসে সারারাত কাটালাম। মাঝে মাঝে দাদাকে সান্ত্বনা দিয়ে ঘুমাতে বলছিলাম সকালে আমার বন্ধু কাফিজ এবং আহাম্মদকে বাড়িতে ডেকে এনে দাদার অসুখের কথা বিস্তারিত জানালাম। কিন্তু ওরা এ বিষয়ে তেমন কোনো পরামর্শ দিতে পারলো না। দেশের পরিস্থিতিও দিন দিন অবনতির দিকে। নওগাঁ শহর পর্যন্ত পাকিস্তানী সেনাবাহিনী চলে এসেছে, ক্যাম্প করেছে সেখানে। নরপশুরা পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারছে। শহরে জনমানবের চিহ্ন নেই। গ্রামের মানুষ রেডিওতে নিয়মিত খবর শোনে। তখন বিবিসি’র খবরেই এ দেশের মানুষের উপর পাকিস্তানী সৈন্যদের অত্যাচারের সঠিক চিত্র তুলে ধরতো। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে খবর পাওয়া গেল লুৎফর রহমান নামে নওগাঁর একজন ভালো ডাক্তারের। ডাক্তার সাহেব নওগাঁ আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা। নিরাপত্তার কারণে নওগাঁ শহর ছেড়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের পোরসা গ্রামে অবস্থান করছেন। আমি একটা চিঠি দিয়ে একজনকে সাইকেলে ডাক্তার সাহেবের কাছে পাঠাই। ডাক্তার সাহেব চিঠি পেয়ে আমাদের বাড়ি আসলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, আমি প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছি। তোমরা ওনাকে ভারতে নিয়ে যাও। ডাক্তার সাহেব দাদাকে ক্যাথেটার পরিয়ে দিলেন । (মূত্রনালীর সংক্রমণের চিকিৎসায় সাধারণত ক্যাথেটার ব্যবহার করা হয়।) ক্যাথেটার পরানোর পর দাদা অনেক আরাম পেল। ডাক্তার লুৎফর রহমানের পরামর্শ মতে আমার ফুফা আলহাজ্ব আজিরুদ্দীনের ছোট ভাই খলনা গ্রামের আব্দুল জব্বার চাচা, কাফিজ ও ছইফুদ্দীন গরুর গাড়িতে দাদাকে তুলে নিয়ে ভারতের বালুরঘাটের পথ ধরি। আমাদের গ্রাম থেকে মাত্র ৮/১০ মাইল হবে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় এই বালুরঘাট প্রথমে পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয় এবং ১৮ আগস্ট পর্যন্ত বালুরঘাটে পাকিস্তানী পতাকা উড্ডীন ছিল। পরে সংশোধিত নির্দেশিকায় ১৭ আগস্ট রাতে মালদার ১৫টি থানার মধ্যে ৫টিকে পাকিস্তানে রেখে বাকি ১০টি থানা ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদা বিভাগের একটি জেলা দক্ষিণ দিনাজপুর। বালুরঘাট এই জেলার জেলা সদর। বালুরঘাট ও গঙ্গারামপুর এই দুই মহকুমা নিয়ে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা গঠিত।
ভারতের বালুরঘাটে দাদার অনেক পরিচিত লোকজন ছিল। আমাকে তাদের ঠিকানা দিলেন। আমি তাদের একজনকে খুঁজে বের করে একটা আশ্রয়ের ব্যবস্থা করলাম। মি. নৃপেন্দ্রনাথ চৌধুরী ছিলেন দাদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু পত্নীতলা থানার কাঁটাবাড়ি গ্রামের। দেশ ভাগের সময় তিনি বিনিময়ের মাধ্যমে ভারতে গমন করেন। বহু বছর ধরে তাদের দেখা সাক্ষাৎ নেই। আমি দাদাকে নিয়ে তাঁর বালুরঘাটের বাসায় গেলাম। তিনি আমাদের বাইরের ঘরে থাকতে দিলেন। দাদার অসুখের বিবরণ শুনে নৃপেন বাবু বললেন, কোনো সমস্যা হবে না, আমি তাঁর চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করবো। দাদা অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে আমাদের বললেন, এখন তোমরা দু’জন থাকো। আমি, ছফে দাদা ছাড়া বাকি সবাই ফিরতি গরুর গাড়ি করে পূর্ব পাকিস্তানে আমাইপুকুর চলে গেলেন।
১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার শুরুতেই আমরা ভারতে প্রবেশ করি। তবে পাকিস্তানী আর্মির ভয়ে নয়, দাদার চিকিৎসার জন্যে। নৃপেনবাবু বালুরঘাট সরকারি জেলা হাসপাতালের একজন নামকরা ডাক্তার মি. বোসের সঙ্গে যোগাযোগ করে দাদার জন্য ওই হাসপাতালে একটা কেবিনের ব্যবস্থা করে দিলেন। পরের দিনই দাদাকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। নৃপেন বাবু দাদার বন্ধু, তাই তাকেও দাদু বলেই ডাকা শুরু করি। আমরা বালুরঘাটে আসার দু’একদিনের মধ্যেই হাজার হাজার আহত মানুষ চিকিৎসার জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে বালুরঘাট জেলা হাসাপাতালে আসতে শুরু করে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নির্বিচারে নিরস্ত্র জনতার উপর গুলিবর্ষণ করায় এসব মানুষ জখম হয়, অনেকে মারা যায়। পূর্ব পাকিস্তানে তখন হাসপাতালেও চিকিৎসা নেওয়ার উপায় ছিল না। সীমান্তের ওপার থেকে শত শত মানুষ চিকিৎসা নিতে ভারতের এই হাসপাতালে আসতে শুরু করায় বেড সংকট দেখা দেয়।
যাই হোক, এই অবস্থার মধ্যেই আমাদের দিন কাটতে লাগলো। একদিন নৃপেন দাদু আমাকে বাড়ির অন্দরমহলে ডেকে নিয়ে তার এবং দাদার নানা স্মৃতি রোমন্থন করার এক পর্যায়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘তোমাদের ঠাকরাল দীঘির এখন কী অবস্থা? অনেক বড় বড় রুই, কাতলা মাছ ছিল তোমাদের দীঘিতে।’ আমি বললাম- ‘সঠিক জানি না দাদু দীঘির কী অবস্থা। কারণ আমি এখন ঢাকায় লেখাপড়া করি। তবে শুনেছি আমাদের দীঘিতে এখনো বেশ বড় সাইজের রুই, কাতলা আছে।’ দাদু আমার কথা শেষ হতেই বলতে শুরু করলেন- ‘তোমাদের বাড়ির কাছেই আমার বাড়ি ছিল, প্রচুর ধন-সম্পদ ছিল আমাদের। আমি বহুবার বড়শী দিয়ে তোমাদের দীঘি থেকে মাছ ধরেছি।’ একটু থেমে অনেকটা আফসোসের সুরে বললেন- ‘বালুরঘাটে বড় সাইজের রুই-কাতলা পাওয়া যায় না। কতকাল থেকে আমরা বড় মাছ চোখে দেখি না।’ নৃপেন দাদুর এমন কথা শুনে আমার খুব মায়া হলো। আমি হাসপাতালে এসে দাদাকে নৃপেন দাদুর বড় মাছ না খাওয়ার আক্ষেপের গল্প শোনালাম। এ কথা শুনে দাদা আমাকে আমাইপুকুর গিয়ে দীঘি থেকে বড় রুই, কাতলা ধরে বালুরঘাট নিয়ে আসতে বলল।
দাদার নির্দেশ মতো আমি বাড়ি এসে আমাদের ম্যানেজারের সহযোগিতায় মাছ ধরার ব্যবস্থা করি। একবার জাল টানার পর দেখা গেল দানব আকৃতির রুই কাতলার সে কী লাফালাফি। আমি কোনোদিন বেড়জাল দিয়ে মাছ ধরা দেখি নাই। এত বড় বড় মাছ দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। বড় তিনটি মাছ রেখে বাকিগুলো আবার দীঘিতে ছেড়ে দেওয়া হলো। একটা মাছ বাড়ির জন্য রেখে বাকি দুটি মাছ (একটা রুই, একটা কাতলা) দু’বস্তায় ভরি। বস্তা দুটি সাইকেলে তুলে আমরা তিনজন হেঁটে হেঁটে বালুরঘাটের পথ ধরি ।
সকাল ১০ টার দিকে রওনা হই। সাইকেল নিয়ে আঁকাবাঁকা পথে ১৫ মাইল রাস্তা হেঁটে বালুরঘাট পৌঁছতে সময় লাগলো প্রায় ৫ ঘন্টা। কাতলা মাছটার ওজন আনুমানিক ৩০ সের এবং রুইয়ের ওজন ২২ সেরের মতো হবে। বালুরঘাট শহরে ঢুকতেই উৎসুক লোকজন জানতে চাইছিল বস্তায় কী আছে দাদা? উত্তরে আমি বলি মাছ। এ কথা শুনে সবাই মাছ দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। একরকম জোর করেই আমাদের সাইকেল থামাতে বাধ্য করলো। মানুষজনের এই অবস্থা দেখে প্রথমে আমরা ভয় পেয়ে যাই। তবে মাছ দেখানোর পর বুঝলাম আসলে ভয়ের কিছু নেই। আমরা বস্তা খুলে তাদের মাছ দেখানো মাত্রই উপস্থিত লোকজনের মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা। প্রচণ্ড ভিড়, মাছ দেখতে প্রায় ৭০/৮০ জন মানুষ আমাদের চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। ছেলে, মেয়ে, বুড়ো সবার চোখ চড়কগাছ।
এইভাবে নৃপেন দাদুর বাসায় যেতে যেতে কম পাঁচ বার মাছ দেখাতে হয় লোকজনকে। উৎসুক জনতার কেউ কেউ আমাদের পিছন পিছন হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে নৃপেন দাদুর বাসা পর্যন্ত। বাসার আঙ্গিনায় মাছ দু’টো নামানোর পর নৃপেন দাদু এবং বাসার অন্য সবাই এত বড় বড় মাছ দেখে অবাক হয়ে যান। কাতলা মাছটা রেখে রুইটা তার ছেলে অমরনাথের সঙ্গে, আমাকে দিয়ে জেলা হাসপাতালের ডাক্তার বোসের বাসায় পাঠালেন। তখন সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়। ডাক্তার বোস আমার লেখাপড়ার বিষয় জানতে চাইলেন। বললেন- ‘একসময় আমার বাড়িও ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। তোমাদের জগন্নাথ কলেজের কাছে বাংলাবাজারে। আমি ওখানে ক্লাস এইট পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি। পরে আমার বাবা-মা পরিবারসহ কলকাতায় চলে আসেন।
তোমার দাদুকে নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না বলে ডাক্তার বোস আমাকে আশ্বস্ত করলেন। বললেন- ‘আমি সব ব্যবস্থা করবো। তুমি তো কিছু খাওনি বলে মনে হচ্ছে। নাস্তা করো, তারপর মাছসহ ড্রাইভারকে দিয়ে তোমাকে আমার শ্বশুরবাড়ি শিলিগুড়ি পাঠাবো। এখানে এত বড় মাছ খাওয়ার লোক নেই আমাদের।’ ভাবছি আমি এত ক্ষুধার্ত যে এখন ভাতের ব্যবস্থা হলে ভাল হয়। সেই সকালে বাড়ি থেকে পান্তা ভাত খেয়ে এসেছি। রাস্তায় কোনো কিছু খাওয়া হয়নি। তারপর দাদার সঙ্গেও দেখা হলো না। মাছের কথাও বলা হলো না। আবার দাদার জন্যে মাছ আনতেও ভুলে গেছি। ডাক্তার বোসের কথা ফেলতে পারলাম না। নৃপেন দাদুর ছেলে অমরনাথকে বলে জীপ গাড়িতে গিয়ে বসলাম। বালুরঘাট থেকে শিলিগুড়ি কত দূর তা আমার জানা নেই ।
জীপ চলছে তো চলছেই, রাস্তার শেষ নেই। ততক্ষণে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। কিভাবে রাত ১২টায় শিলিগুড়ি এসেছি তা বলতে পারবো না। বাসার সামনে জীপ থামতেই আমাকে আদর করে দোতলার একটি কক্ষ দেখিয়ে দিলেন এক ভদ্র মহিলা, সম্ভবত ডাক্তার বোসের স্ত্রী। বুঝলাম আমরা শিলিগুড়ি রওনা হওয়ার আগেই ডাক্তার বোস ফোন করে দিয়েছিলেন শ্বশুর বাড়িতে কিছুক্ষণ পর ভদ্রমহিলা শুধুমাত্র এক কাপ চা দিয়ে বললেন- ‘বাবু, তুমি চা খেয়ে স্নান করো- তোয়ালে, লুঙ্গি বাথরুমে দিয়েছি।’ আমি মনে মনে বললাম- ‘আবার চা ! ভাত কি ভারতের মানুষ খায় না? ‘
গোসল সেরে রুমে এসে দেখি টেবিলে আমার জন্য খাবার রাখা আছে। মাছ, মুরগির মাংসসহ বেশ কয়েকটি পদ। আমি খাবার টেবিলে বসে আছি। ওনারা না বললে তো খেতে পারি না। এমন সময় ডাক্তার বোসের স্ত্রী এসে খাওয়ার কথা বলে আবার অন্য ঘরে চলে গেলেন। বিশাল পরিবার, তেমনি জমিদারী স্টাইলের বাড়ি। বাড়ির ভেতর থেকে অনেক লোকজনের জোরে জোরে কথা বলার আওয়াজ পাচ্ছি ওরা মাছ দেখে এত আনন্দ উল্লাস করছে, তা আর বুঝতে বাকি রইলো না।
খুব সকাল সকাল মাছ ধরার আয়োজন, তারপর সেটাকে সাইকেলে বেঁধে হেঁটে হেঁটে বালুরঘাট আসা, সেখান থেকে শিলিগুড়ির সারা রাস্তা জীপের ঝাঁকুনি, সবমিলিয়ে খুব ধকল গেছে আমার উপর। অবসন্ন শরীরে বিছানায় যেতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে আমার রুমে দু’তিন বার কেউ এসেছিল। কিন্তু গভীর ঘুমে থাকায় কেউ আমাকে ডাকেনি।
সকাল সাড়ে নয়টা, আমি গোসল করে রুমে বসতেই বৌদি মানে ডাক্তার বোসের স্ত্রী আমাকে ডেকে খাবার টেবিলে নিয়ে গেলেন। নাস্তার জন্য পরোটা, ভাত, ডাল, সবজি এবং আমার আনা রুই মাছের ঝোল ও নানা পদের তরকারিসহ টেবিল সাজানো।
ডাইনিং টেবিলের চারপাশে বসেছেন পরিবারের সদস্যরা। এত লোকের মধ্যে খেতে বসে আমার বেশ লজ্জা করছিল। ডাক্তার বোসের আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে পরিচয় পর্ব শেষে আমাকে খাওয়া শুরুর জন্য বললেন বৌদি। আরও বললেন- ‘আমার জামাইতো তোমার দাদার চিকিৎসা করছে বলে জানিয়েছে। জামাইয়ের বাপ-দাদার ভিটেমাটিও ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। সে বলেছে তুমি সেখানকার ছেলে নম্র, ভদ্র। জামাই আরো বলেছে এত সুন্দর ছেলে তোমরা কখনো দেখোনি। এখন তোমাকে আমরা দেখলাম। জামাই সঠিক বলেছে ।
আমিও তাদেরকে খেতে বসার জন্য অনুরোধ করলাম। কিন্তু তারা বললেন- ‘আমরা তোমার আনা মাছ রান্না করে আগেই অতি তৃপ্তিসহকারে করে খেয়েছি।’ ডাক্তার বোসের শ্বশুর মশাই বড় সরকারি চাকুরে। উনিও বললেন- ‘এত বড় মাছ এবং এত স্বাদের মাছ আমরা কখনো খাইনি। ভগবান তোমাকে এবং তোমার দাদুকে সুস্থ রাখুন।
সবাই একের পর এক প্রশ্ন করছিল। একা একা খেতে আমার খুব লজ্জা করছিল। তারাও বোধকরি টের পাচ্ছিলেন। সকাল ১১ টার দিকে আমি বালুরঘাটের উদ্দেশ্যে জীপে উঠি। ডাক্তার বোসের স্ত্রী ছয় বাটির একটা টিফিন কেরিয়ার ড্রাইভারের হাতে দিলেন। ওতে আমার আনা মাছের তরকারি। জীপের চারধারে এসে ১০/১৫ জন পুরুষ ও মহিলা আমাকে বিদায় জানালেন। ডাক্তার বোসের শাশুড়ি আমার মাথায় বারবার হাত বুলিয়ে আদর করলেন। বিদায় বেলা বললেন- ‘আবার এসো, কেমন?’ জীপে বসে শুধু মনে হলো, আমি এত আদর-যত্ন তো কখনো পাইনি। তারা তো আমার আত্মীয় নন। ধর্মেও আলাদা অথচ বুকভরা ভালোবাসা এদের। ডাক্তার বোসের শাশুড়ির সেই কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে। আসতে আসতে প্রতিজ্ঞা করি, আবার মাছ নিয়ে শিলিগুড়ি আসবো। আর সেটা রুই নয়, আনবো খুব বড় সাইজের দুটা কাতলা।
সন্ধ্যায় বালুরঘাটে নেমেই সোজা হাসাপাতালে দাদার কেবিনে গেলাম। দাদা অনেকটা সুস্থ আছেন দেখে খুশি লাগলো। দাদাকে মাছ নিয়ে শিলিগুড়ি যাওয়া, বাড়ির নানা সমস্যার কথা জানালাম। রাতে নৃপেন দাদুর বাসায় ফিরলাম। ছফে দাদা পেশাদার বাবুর্চি নন। আমাদের নিকটআত্মীয়, দাদা বলে ডাকি। বাবাও তাঁর জীবদ্দশায় ভারত যাওয়ার সময় ছফে দাদাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। বালুরঘাটে ছফে আমার দাদার জন্য দু’বেলা রান্না করে খাবার হাসপাতালে দিয়ে আসতো। আমি শিলিগুড়িতে যাওয়ার পরদিন নৃপেন দাদুর বাসা থেকে রান্না করা মাছের ঝোল, মাছ ভাজা ও মুড়োঘন্ট পাঠিয়েছিলেন। শুনে আমি অনেক শান্তি পেলাম ।
শিলিগুড়ি থেকে ফেরার পর ডাক্তার বোসের স্ত্রী এবং শাশুড়ি মায়ের স্নেহ, আদর আর আমার ভূয়সী প্রশংসার কথা মনে হতে লাগলো। আমি তো এত আদর-যত্ন কোনোদিন পাইনি। এক সময় খাওয়ার টেবিলে ডাক্তার বোসের শাশুড়ি আমাকে আমার মা-বাবা কে কি করেন বা কোথায় থাকেন জিজ্ঞাসা করায় আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। তারপর এক সময় সত্যিটা বলে দেই আমার যখন চার বছর বয়স তখন বাবা মারা যান। মা পরে অন্যের সংসারে চলে যেতে বাধ্য হন। তবে এখনো মা আমাকে প্রায়ই দেখতে আসেন। এসব কথা শুনে তারা আমাকে একটা প্রস্তাব দেন। তুমি আর পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যেও না। আমাদের কাছেই থেকে যাও। আমরা তোমাকে এদেশে পড়ালেখা করাবো। তাদের এসব কথা শুনে আমি বলেছিলাম- ‘আমাদের অনেক সম্পদ আছে, বড় আপা, ছোট বোনেরা আছে। তাছাড়া বৃদ্ধ দাদা, যে আমাকে তার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসে। তাদের ছেড়ে কি এখানে থাকা যায়?”