ঢাকা, সোমবার, ৯ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৪শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

লাইট এট দ্যা এন্ড অব দ্যা ট্যানেল

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল ও ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর

শেষমেশ ওমিক্রন এসেই গেল। ওমিক্রনের খপ্পরে এখন বাংলাদেশ। এতদিন যা দেখেছি টিভির খবরে ইউরোপে আর আমেরিকায়, এখন তা-ই আমাদের জন্য জ্বলজ্যান্ত বাস্তবতা। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ওমিক্রন। ম্যাথমেটিক্যাল মডেলিং করে বিশেষজ্ঞরা দেখিয়েছেন কোন দেশে ওমিক্রন প্রথম শনাক্ত হওয়ার ২৮ দিনের মধ্যে তা ওই দেশে কোভিডের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গাটা দখল করে নিচ্ছে। সেই বিবেচনায় জিন সিকোয়েন্সিং না করেই বলে দেয়া যায় যে, এদেশে এখন যত মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের মধ্যে ডেল্টা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন হওয়ারই কথা। এখন আমরা বাংলাদেশে যা দেখছি তার বেশিরভাগই ওমিক্রন হওয়ার সম্ভাবনা।

কোন দেশে ওমিক্রন প্রথম শনাক্ত হওয়ার ২৮ দিনের মধ্যে তা ঐ দেশে কোভিডের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গাটা দখল করে নিচ্ছে। সেই বিবেচনায় জিন সিকোয়েন্সিং না করেই বলে দেয়া যায় যে, এদেশে এখন যত মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের মধ্যে ডেল্টা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন হওয়ারই কথা। এখন আমরা বাংলাদেশে যা দেখছি তার বেশিরভাগই ওমিক্রন হওয়ার সম্ভাবনা।

ওমিক্রন নিয়ে আমরা শুরু থেকেই এক ধরনের বোকার স্বর্গে বাস করছি। আমাদের মাথায় কীভাবে যেন ঢুকে, গেথে গেছে যে ওমিক্রন ডেল্টার চেয়ে পাঁচ থেকে দশগুণ বেশি সংক্রমনশীল হলেও এতে কারও মারা যাওয়া তো দূরে থাক, আইসিইউতে ভর্তি হওয়ারও কোনো শঙ্কা নেই। ফলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাতো বাদই দেন, মাস্কেরও বালাই দেখা যাচ্ছে না কারও নাকে-মুখে। অথচ আমরা একবারও চিন্তা করছি না যে, ২০২০-এ যখন প্রথম কোভিড নাজিল হলো, তখনও তো ছিল না ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। ছিল না বিটা কিংবা লামডাও। তারপরও তো আমেরিকা আর ইউরোপের দেশে দেশে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়েছিল। নিউইয়র্কে আমরা খুঁড়তে দেখেছি আগাম গণকবর আর কফিনের অভাবে লাশজট দেখা দিয়েছিল ইতালির হাসপাতালগুলোর মরচুয়ারিগুলোতে। আর ওমিক্রন তো সেই সার্স-কোভ-২-এরই উত্তরসূরি। কাজেই এমনটি ভাবার কোনো কারণই নেই যে ওমিক্রনে বাড়বে না আইসিইউগুলোতে ভিড়।

তাছাড়া আরেকটি বিষয়ও মাথায় রাখা জরুরি। এই ভ্যারিয়েনটি যেহেতু খুব তাড়াতাড়ি ছড়ায়, এতে রাতারাতি বহুলোক আক্রান্ত হয়ে পড়েন। এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই আমরা একদিনে দশ লাখের বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হতে দেখেছি ক’দিন আগেই। নতুন রোগী শনাক্তের সব রেকর্ড ভেঙে গেছে এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডসসহ ইউরোপের দেশে দেশে। এতসব নতুন রোগীর দু-চার-পাচ শতাংশও যদি হাসপাতালে ভর্তি হয়, তাতেই কিন্তু হাসপাতালগুলোর সব বেড রাতারাতি ভরে যাবে।

তাছাড়া ডাক্তার, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী যখন নিজেরাও এর ফলে দলে দলে আক্রান্ত হবেন তখন ভেঙে পড়তে পারে পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাই। এই অবস্থা কদিন আগেই আমরা দেখেছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এখনও সেখানে সাধারণ একটি কোভিড টেস্ট করতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে তিন-চারদিনেরও বেশি, আর যুক্তরাজ্যে রোগীদের বেডের অভাবে হুইল চেয়ারে বসিয়েই হাসপাতালগুলো চিকিৎসা দিচ্ছে। প্রতিবেশী ভারতেও প্রায় ২৫ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এরই মধ্যে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন।

শুধু স্বাস্থ্যখাতেই নয়, ওমিক্রনের ধাক্কা লাগতে শুরু করেছে অন্যান্য সেক্টরেও। আক্রান্ত হচ্ছেন অন্য ফ্রন্টলাইনাররাও। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্যান্য পরিষেবা। কোনো কোনো দেশে এরই মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ ট্রাকচালক কোভিড পজিটিভ হয়ে পড়েছেন, যার সরাসরি প্রভাব পড়তে শুরু করেছে পণ্য পরিবহনে। ফলে শুধু যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীরই দাম বাড়তে শুরু করেছে তাই নয়, এর ফলে ভ্যাকসিন পরিবহন এবং ভ্যাকসিনেসন কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে।

কাজেই ওমিক্রনকে যদি সামাল দিতে হয় তাহলে একে কোনোভাবেই এতটুকুও গুরুত্ব না দেয়ার কোনো কারণই থাকতে পারে না। ওমিক্রনকে ঠিকঠাক মতো সামাল দেওয়ার আরও একটা বড় তাগিদও কিন্তু আছে। এতদিন আমরা যখনই লকডাউনে গেছি আমাদের লক্ষ্য ছিল স্বল্পমেয়াদি- কোভিড কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে আর আমরা আবার কিছুটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবো কোভিডের পরে ওয়েভটা আসার আগ পর্যন্ত।

এবারের পরিস্থিতি কিন্তু একেবারেই আলাদা। এবারই প্রথম আমরা সম্ভবত কোভিডের শেষ দেখতে পাচ্ছি। প্যান্ডেমিকের চরিত্র, বিশেষ করে আরএনএ ভাইরাসগুলোর প্যান্ডেমিক, বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রথমে প্যান্ডেমিকের একটা বড় ওয়েভ আসে যাতে অনেকে মৃত্যুবরণ করেন, যেমনটি আমরা কোভিডের বেলায় দেখেছিলাম ২০২০-২০২১-এ। এর পরের ওয়েভটি হয় আরও মারাত্মক যখন আরও অনেক বেশি লোক সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, যা করে দেখিয়েছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট।

এর পরের যে ওয়েভটি আসে সেখানে দায়ী ভ্যারিয়েন্টটির সংক্রমণশীলতা অনেক বেশি হলেও তার ভিরুলেন্স অর্থাৎ মারাত্মক রোগ সৃষ্টির সক্ষমতা অনেক কম থাকে। ভাইরাসটির যদি এরপর বড় আর কোনো মিউটেশন না ঘটে, তাহলে এর পরপর ভাইরাসটি ক্রমেই দুর্বল হয়ে এক সময় এন্ডেমিকে পরিণত হয়। অর্থাৎ এরপর এভাবে আর কোনো ওয়েভ আসবে না, যদিও বেশকিছু মানুষ তারপরও আক্রান্ত হবেন আর কোথাও, কখনো হঠাৎই আউটব্রেক দেখা দেবে, যা স্থানীয় পর্যায়ে লকডাউন এবং অন্য স্বাস্থ্যবিধিগুলো কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা যাবে। ওমিক্রনের কাছ থেকে ঠিক তেমনটাই প্রত্যাশা এখন আমাদের। ঠিক এমনটাই আমরা দেখেছিলাম গত শতাব্দিতে স্প্যানিশ ফ্লুর বেলায়ও। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধানের বক্তব্যেও এমনটাই উঠে এসেছে।

পাশাপাশি আরেকটি বিষয়ও লক্ষণীয়। ওমিক্রন যেহেতু অনেক বেশি সংক্রমণশীল, বোঝাই যাচ্ছে অনেক বেশি মানুষ খুব তাড়াতাড়ি পৃথিবীব্যাপী এই ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত হতে যাচ্ছেন। পাশাপাশি ডেল্টা জমানার তুলনায় আজ বাংলাদেশে তো বটেই, পৃথিবীর অনেক দেশেই ভ্যাকসিনেটেড মানুষের সংখ্যাও অনেকগুণ বেশি। ফলে হার্ড ইমিউনিটির যে বিষয়টি প্রায়ই কোভিড নিয়ে আলোচনায় সামনে চলে আসে, ওমিক্রন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় সেই অতি মূল্যবান হার্ড ইমিউনিটিও অর্জনের একটা সুযোগ মানবজাতির সামনে চলে আসছে বলে কেউ কেউ মত দিচ্ছেন। তবে একটা কথা মনে রাখা জরুরি।

ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ালেই কিংবা জনসংখ্যার ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষকে টিকা দিলেই যে হার্ড ইমিউনিটি অর্জিত হয়ে যাবে, এমন কোনো বেদবাক্য কিন্তু নেই। এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি কিংবা হেপাটাইটিস সি’র বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটি কখনোই ডেভেলপ করেনি। সার্স-কোভ-২-এর ক্ষেত্রেও এমনটি দেখা দিতে পারে। মনে রাখতে হবে মোট জনসংখ্যার ৬২ শতাংশের দুই ডোজ ভ্যাকসিনেশন, ৬১ লাখ কোভিড রোগী, প্রায় সাড়ে ৮ লাখ কোভিডজনিত মৃত্যুর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হার্ড ইমিউনিটি তো ডেভেলপ করেইনি বরং ইদানীং প্রায়ই দেশটিতে দৈনিক নতুন কোভিড রোগী শনাক্তের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

তবে এত সব আশার ভিড়ে একটা কিন্তু খুব বড় ‘কিন্তু’ রয়ে গেছে। ওমিক্রনের কল্যাণে কোভিড তখনই এন্ডেমিক হবে, যদি না এই পর্যায়ে এসে ভাইরাসটির আরও কোনো বড় ধরনের মিউটেশন হয়। সার্স-কোভ-২-এর এ পর্যন্ত যত মিউটেশন আমরা দেখেছি তার সবই ভাইরাসটি স্পাইক প্রোটিনে। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই কাল ভাইরাসটির এন প্রোটিনে কোনো মিউটেশন দেখা দিল, তাহলেই কিন্তু পরিস্থিতি রাতারাতি খুব খারাপের দিকে বদলে যাবে।

স্পাইক প্রোটিন ব্যবহার করে এ ভাইরাসটি মানুষের সেলে প্রবেশ করে আর এখন পর্যন্ত আমাদের হাতে যে কটি কোভিড ভ্যাকসিন আছে তার সবগুলোই ডেভেলপ করা হয়েছে এই স্পাইক প্রোটিনটিকে টার্গেট করেই। এন প্রোটিনটি মানুষের সেলে ভাইরাসটির রেপ্লিকেশন বা বংশ বৃদ্ধির জন্য দায়ী। যদি কোনো কারণে এখানে কোনো মিউটেশন ঘটে যায়, মানবজাতিরও মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকবে না।

আর ভাইরাসের মিউটেশন তখনই ঘটবে যখন ভাইরাসটি খুব তাড়াতাড়ি একজন থেকে আরেকজন এবং আরেকজন থেকে আরও বহুজনে ছড়িয়ে পড়বে। অর্থাৎ আমরা যখন টিকা নেব না, মাস্ক পরবো না আর পরলেও পরবো থুতনিতে, আমরা যখন হাত ধুবো না, ঘুরে বেড়াবো যত্রতত্র যখন খুশি যেখানে-সেখানে আর সামাজিক, ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের বন্যা বইবে এই শীতে তখনই বাড়বে ভ্যারিয়েন্টটির মিউটেশনের শঙ্কা। অতএব সাধু সাবধান! সাবধান হন, হন সচেতন! কারণ এবার যদি আমরা জিতে যাই সেই জয়টা সম্ভবত দীর্ঘমেয়াদি হতে যাচ্ছে। বলা যায় না হতে পারে চলতি বছরের শেষেই হয়তো কেটে যাবে মেঘ আর আমরা ফিরে যাবো আমাদের চিরচেনা ‘ওল্ড নরমালে’!

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর
রিসার্চার, এহিমি বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান।