কভিডকালের এই সময়ে আমাদের খেটে খাওয়া মানুষের কি অবস্থা, সেটা মোটামুটি সকলেই জানি। খেটে খাওয়া মানুষগুলোর সঞ্চয় থাকে না। প্রতিদিনের খাবারের ব্যবস্থা তাদের প্রতিদিনই নিশ্চিত করতে হয়। আয় করলে, তবেই খরচ। দিনমজুর অনেকের আয় রোজগার প্রায় বন্ধ। এই মানুষগুলো তাদের প্রয়োজনীয় খাবারটুকু কেনেন, সারাদিন কাজ করার পর। কিন্তু যদি কাজ না থাকে, তাহলে না খেয়ে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।
কভিডের এই সময়ে মানবিকতার পাশাপাশি বেশ কিছু অমানবিক ঘটনা চোখের সামনে দেখেছি। সেরকমই একটা ঘটনা ব্যাখ্যা করছি, তবে নামগুলো কাল্পনিক।
শরীফ আমিন সাহেব একজন পয়সাওয়ালা মানুষ। তার বেজায় বুদ্ধি। সবাই ওনার বুদ্ধির তারিফ করে। পরিবারের সদস্য চারজন। স্বামী, স্ত্রী আর দুই ছেলে-মেয়ে।
শরীফ আমিন সাহেবের বাসায় নতুন একজন কাজের মানুষ দরকার। যদিও আগে থেকে রীনা নামের একটা মেয়ে কাজ করে আসছিলেন। বড় বাড়ি। দুইজন কাজের মানুষ না হলে হয় না।
মেরিনা বানু নামের একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলাকে কাজের জন্য ঠিক করা হলো। কাজের সংখ্যা অনুযায়ী মাসের বেতন দেয়া হবে। এভাবেই এখন গ্রাম, উপ-শহর কিংবা শহরের বাসা-বাড়ির কাজের বেতন দেয়া হয়।
বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার করে বলি। যেমন,
* কাপড় পরিষ্কারের জন্য ৭০০ টাকা;
* ঘর পরিস্কারের জন্য ৭০০ টাকা;
* মাছ-মাংস ও সবজি কোটার জন্য ৭০০ টাকা;
* সকালের নাস্তা বানানোর জন্য ৭০০ টাকা।
অর্থাৎ এই ৪টি কাজের জন্য মাস শেষে মেরিনা বানু ২৮০০ টাকা পাবেন। মেরিনা বানু ভেবেছিল যেহেতু বাসায় চারজন মানুষ, তাহলে এই বাড়ির কাজ শেষ করে তিনি আরেকটি বাড়ির কাজ নিতে পারবেন। সাহেবের বাসায় কাজ শুরু করে দিলেন। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো অন্য জায়গায়।
শরীফ আমিন সাহেব পয়সাওয়ালা মানুষ হবার কারণে আত্মীয়-স্বজনের সংখ্যাও অনেক বেশি। যে কারণে চারজনের বাসায় আত্মীয়-স্বজন সবসময় পাঁচ জনের বেশি থাকত।
এইসব আত্মীয়-স্বজনের কাপড়-চোপড় মেরিনা বানুকেই মানুষ পরিষ্কার করতে হয়। বাড়িতে মানুষজন বেশি থাকার কারণে ঘরবাড়িও বেশি নোংরা হয়। সেগুলো পরিষ্কার করতে হয়। প্রতিদিন সকালে নাস্তা তৈরি করতে হয় ৯ থেকে ১০ জন মানুষের। বাড়ির সবাই আবার ছোট মাছ, সবজি পছন্দ করে। সেইসব কাজ করতেও অনেক বেশি সময় লাগে।
মাসের বেতনের তুলনায় কষ্ট বেশিই হয়ে যায়, কিন্তু কিছুই করার নাই। তাকে তো ৪ রকম কাজের আইটেমের কথা বলে ঠিক করা হয়েছিল। প্রতিটা কাজের পরিমাণ কি হবে সেটা বলা হয়নি। কি আর করা? মেরিনা বানুর কাজ চলছিল।
বিভিন্ন দেশের ভ্যারিয়েন্ট সমেত দেশে করোনা ভাইরাসের পুনরায় আবির্ভাব হলো। আত্মীয়-স্বজনরা যে যার মত করে নিজেদের বাড়িতে চলে গেল। মেরিনা বানু একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক কাজের পরিমাণ একটু কমে আসছে। শরীফ আমিন সাহেব করোনার কারণে ছেলে-মেয়ে দুইজনকেই কানাডা পাঠিয়ে দিলেন। মেরিনা বানুর দৈনিক কাজের চাপ আরেকটু কমে গেলো। তবে তিনি কখনো কাজে ফাঁকি দিতেন না। সব কাজ নিষ্ঠার সাথেই করতেন।
আগেই বলেছি, শরীফ আমিন সাহেবের বুদ্ধির প্রশংসা সবাই করে থাকে। করোনার এই সময় যেহেতু তার বাইরে যাওয়ার বেশি প্রয়োজন হয় না, তাই তিনি চিন্তা করলেন, মেরিনা বানু এত অল্প কাজ করে মাসে ২৮০০ টাকা নিয়ে যাচ্ছে, এটা বেইনসাফি। তিনি খুব মনঃপীড়ায় ভুগতে লাগলেন। বলে রাখা ভালো, শরীফ আমিন সাহেবের কাছে কাজের মানুষকে ২৮,০০০ টাকা বেতন দেওয়াও কোন সমস্যা না।
তারপরেও ভাবতে লাগলেন, দুজনের সংসার। ঘরের কাজ কর্ম তেমন নাই। ঘরে এখন যে কাজ, সেটা পুরানো গৃহকর্মী রীনাই করতে পারে। তাহলে শুধু শুধু মেরিনাকে রেখে লাভ কি?
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। মেরিনা বানুকে জানিয়ে দিলেন, এই মাসের পর তোমাকে আর আসতে হবে না। দেশের পরিস্থিতি ভালো না। সবকিছু ঠিকঠাক হোক। নতুন করে কাজের লোকের দরকার হলে, তোমাকেই অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
দেশে করোনাকাল চলছে। মেরিনা বানু খুব ভালো করেই জানে, দেশের এই পরিস্থিতিতে কাজ চলে গেলে, নতুন কেউ তাকে কাজে রাখবে না। কিন্তু তার এখন কিবা করার আছে?
মেরিনা বানু শুধু একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছেন। চার জনের বাড়িতে যখন ১০ জনের জন্য কাজ করতাম, কখনো সামান্য বেতন বাড়িয়ে দেয়া হয়নি। আর যখনই চারজন থেকে মানুষ কমে দুইজন হয়ে গেল, সাথে সাথে কাজ থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হলো। কয়েকটা মাসও অপেক্ষা করা হলো না। এর চেয়েও অমানবিক ঘটনা আপনার সামনেও হয়তো ঘটেছে।
যাই হোক, মাধ্যমিকে পড়েছিলাম সৈয়দ মুজতবা আলীর পন্ডিত মশাই গল্পটি। কিছু অংশ তুলে ধরছি। স্কুল পরিদর্শনের পর স্কুল তিন দিন বন্ধ ছিলো। তো তিনদিন ছুটির পর আবার বাংলা ক্লাস বসেছে। পন্ডিতমশাই টেবিলের উপর পা তুলে দিয়ে ঘুমচ্ছেন, না ঠিক চোখ বন্ধ করে আছেন ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছেনা। কারো দিকে না তাকিয়েই পন্ডিতমশাই হঠাৎ ভরা মেঘের ডাক ছেড়ে জানতে চাইলেন – লাট সাহেবের সাথে আর কে কে এসেছিলো বল তো রে? আমি সমস্ত ফিরিস্তি দিলুম। চাপরাসী নিত্যানন্দকেও বাদ দিলুম না। বললেন, হলো না। আর কে ছিলো? বললুম, ঐ যে একগাদা এডিসি না প্রাইভেট সেক্রেটারি কিন্তু তারা তো ক্লাসে ঢোকেননি। পন্ডিতমশাই রেগে গিয়ে মেঘের গুরু গুরু ডাক ছেড়ে শুধালেন – এক কথা বার বার বলছিস কেন রে মূড়? আমি কালা না তোর মত অলম্বুষ?
আমি কাতর হয়ে বললুম – আর তো কেউ ছিলোনা পন্ডিত মশাই। পন্ডিত মশাই হঠাৎ চোখ মেলে আমার দিকে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললেন, ও উনি, আবার লেখক হবেন। চোখে দেখতে পাসনা কানা, দিবান্ধ। কেন? লাট সাহেবের কুকুরটাকে দেখতে পাসনি? এই পর্যবেক্ষন শক্তি নিয়ে- আমি তাড়াতাড়ি বললুম হ্যাঁ হ্যাঁ দেখছি। পন্ডিতমশাই বললেন, কুকুরটার কি বৈশিষ্ট ছিলো বল তো? ভাগ্যিস মনে পড়লো। বললুম, আজ্ঞে একটা ঠ্যাং কম ছিলো বলে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটছিলো। হুঁ বলে পন্ডীতমশাই আবার চোখ বন্ধ করলেন। অনেকক্ষন পর বললেন শোন! শুক্রবার দিন ছুটির পর কাজ ছিলো বলে অনেক দেরিতে ঘাটে গিয়ে দেখি আমার নৌকার মাঝি এক অপরিচিতের সাথে আলাপ করছে। লোকটা মুসলমান। আমাকে দেখে সেলাম টেলাম দিয়ে পরিচয় দিলো, সে লাট সাহেবের আরদালি, সাহেবের সঙ্গে এখানে এসেছে। পন্ডিত মশাই বললেন, লোকটার সাথে কথাবার্তা হলো। লাট সাহেবের সব খবর জানে। লাট সাহেবের কুকুরটার একটা ঠ্যাং কি করে ট্রেনের তলায় কাটা যায় সে খবরটাও বেশ গুছিয়ে বলল। তারপর পন্ডিত মশাই ফের অনেকক্ষন চুপ থাকার পর আপন মনে আস্তে আস্তে বললেন, আমি, ব্রাক্ষণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কণ্যা, বিধবা পিসি, দাসী মোট আটজনা। তারপর হঠাৎ কথা ঘুরিয়ে ফেলে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মদনমোহন কি রকম অংক শেখায় রে’? মদনমোহন বাবু আমাদের অংকের মাস্টার-পন্ডিত মশায়ের ছাত্র। বললুম ভালই পড়ান।
পন্ডিত মশাই বললেন বেশ বেশ। তবে শোন – লাট সাহেব তার কুকুরের পিছনে মাসে খরচ করেন ৭৫ টাকা। এইবার দেখি তুই কি রকম অংক শিখেছিস। বল তো দেখি – যদি একটা কুকুরের পিছনে মাসে ৭৫ টাকা খরচ হয়, আর সেই কুকুরের তিনটে ঠ্যাং হয় তবে প্রতি ঠ্যাং এর জন্য কত খরচ হয়? আমি ভয় করেছিলুম পন্ডিত মশাই খুব মারাত্মক রকমের অংক কষতে দিবেন। আরাম বোধ করে তাড়াতাড়ি বললুম, আজ্ঞে পঁচিশ টাকা। পন্ডিত মশাই বললেন – সাধু সাধু। তারপর বললেন – আমি, ব্রাক্ষণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কণ্যা, বিধবা পিসি, দাসী মোট আটজনা, আমাদের সকলের জীবনধারণের জন্য আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা। এখন বল তো দেখি এই ব্রাক্ষণ পরিবার লাট সাহেবের কুকুরের কটা ঠ্যাঙের সমান? পন্ডিত মশাইয়ের অংকের প্রশ্নটি আসলেই কঠিন ছিল। আমাদের চারপাশেই অনেকেই আছেন, যারা বিস্তর টাকা পয়সার মালিক। যতই জাকজমকপূর্ণ জীবন যাপন করুক, শেষ হবে না। পর্যাপ্ত অপচয় করে থাকেন। কিন্তু তাদের পাশেই অগণিত মানুষ রয়েছেন, যাদের এই দুর্দিনে তিন বেলা খাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। তাদের পাশে বিত্তবানদের থাকা উচিত। সময় আমাদের কখন, কোথায় দাঁড় করাবে কে জানে? তাই আসুন, কভিডকালের এই সময়ে সকলেই মানবিক হই।
লেখকঃ রিয়াজুল হক, যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক