নব্বইয়ের দশকে আমার জন্ম। জন্মের পর থেকেই যখন থেকে শুনতে অভ্যস্ত হয়েছি তখন থেকেই মায়ের কোলে শোয়ে শোয়ে মার মুখের দিকে তাকিয়ে গল্প শুনতাম। হরেক রকমের গল্প। মার মুখের সবচেয়ে প্রিয় গল্প গুলো ছিলো প্রীতিলতা, বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, নীলিমা ইব্রাহীম, জাহানারা ইমামদের জীবন কাহিনী। তখন হয়তো সবকিছু বোঝার বয়সও হয়ে ওঠেনি। আজ যখন আমার বয়স ত্রিশের কোটা পেরিয়েছে। একাডেমিক শিক্ষা জীবন শেষ হয়েছে তখন সত্যিকার অর্থেই মায়ের মুখে ছোট বেলায় শোনা নারী জাগরণের কথা, নারীর উন্নয়নের কথা, সেই সাথে নারী শিক্ষার বিকাশে যারা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছেন তাদের কিঞ্চিত হলেও বুঝতে পেরেছি।
এই দেশের জন্য, আমাদের নারী সমাজের জন্য তারাই ছিলেন একেকটা উদাহরণ এবং উদাহরণ দেয়ার দালিলিক ভিত্তি। মা হয়তো আমাদের এই গল্পগুলো শুনাতেন এই কারণে যে তিনি সত্তরের দশকে উচ্চ শিক্ষার দরজাটা ছুঁতে পেরেছিলেন বলে৷ আমি যেমন আমার মায়ের মুখে আগের মহীয়সী নারীদের কথা শুনেছি, তেমনি হয়তো আমার অনাগত সন্তান তার মায়ের মুখে এই আধুনিক যুগের তথাকথিত চিন্তা চেতনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যারা সমাজের আর দশটা নারীর সাথে আলোকিত মানুষ হওয়ার প্রতিযোগিতাই নয় বরং আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে নারীদের পাশাপাশি পুরুষদেরও পিছনে ফেলে কাজ করে চলছেন তাদের গল্প শুনবে। আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস এ যাত্রায় যে নামটি প্রেরণা হয়ে থাকবে, চেতনার বাতিঘর সাজিয়ে তুলবে, সাহস যোগাবে আলো ও আধারের পার্থক্য বুজাতে সেই মৌলিক পাতার নামই হলো আমার বোন সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন।
বোন বলছি প্রথমত তিনটা কারণে, যার একটি হলো আমরা তিন ভাই কোনো বোন নেই সেই লোভ থেকে। দ্বিতীয়ত মানুষটি আমাকে ছোট ভাইয়ের মতোই জানেন ও মানেন এটা আমার অগত্যা বিশ্বাস। তৃতীয়ত তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার বাবাও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আদর্শের জায়গাটা আমাদের এক এবং অভিন্ন। যাকে নিয়ে এতো গল্প করছি তার সাথে আমার পরিচয় কর্ম সূত্রে। আর এই সূত্রের সম্পর্ক অতি নিকট আত্মীয়ের চেয়ে কম নয়, বরং কিছু ক্ষেত্রে বেশি হয়ে থাকে। তিনি আমার জেলা নরসিংদী সৃষ্টির পর থেকে সতেরতম জেলা প্রশাসক এবং প্রথম নারী জেলা প্রশাসক। আর আমি একজন নবীন ভাস্কর শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী।
সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন জেলা প্রশাসক হিসেবে নরসিংদীতে নিযুক্ত হওয়ায় আগে থেকেই জেলা প্রশাসনের সাথে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। জেলা প্রশাসনের আঙ্গিনাতেই সেবা বৃত্ত নামক ভাস্কর্য আমার সন্তানের মতোই টিকে আছে অপলক ভঙ্গিমায়। যাইহোক সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন জেলা প্রশাসক হিসেবে নরসিংদীতে নিযুক্ত হলেন। ভাবলাম কেমন হবেন তিনি, শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি কেমন মায়া থাকবে তার এসব নানা অনুষঙ্গ কাজ করতে লাগলো আমার মাঝে। এইসব গভীর ভাবনার কারণ একটাই আমি ব্যক্তি জীবনে যারা শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা করেন তাদের মন থেকে শ্রদ্ধা করি ও ভালোবাসি এবং তাদের অজান্তেই তাদের জন্য পুজো করি। শুধু তাই নয়, তাদের প্রতি ভালোবাসা আমার ষোলকলা আর শ্রদ্ধা সেতো আকাশচুম্বী। তিনি জেলায় এসেই নরসিংদীর সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ও সবার জন্য তৈরি করলেন মুক্তিযুদ্ধ কর্নার। যা সারাদেশেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আর সেই সংবাদটি যখনই দেখতে পাই তখন থেকেই সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন এর জাত ও লেবাস সম্পর্কে আমি আচ করে নিয়েছিলাম।
এবার সাহস নিয়ে যাওয়া যায় মানুষটার কাছে কারণ তার অনুরাগ আছে সংস্কৃতির প্রতি, ঐতিহ্যের প্রতি, দরদ আছে শিল্পের প্রতি। প্রথম পরিচয়েই আকাশের মতো বিশাল হৃদয়ের মণিকোঠা থেকে যে বাক্যগুলো আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন সেদিন থেকেই তার ও তার কাজের প্রতি আসক্ত হয়ে গেলাম । ভাবলাম নারীরা কিঞ্চিৎ সংকীর্ণ মানসিকতার হয়, তাহলে তিনি কি নারীকে জয় করতে পেরেছেন? হ্যাঁ সত্যি তাই, তিনি নারীকে জয় করেছেন, জয় করেছেন আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে। পুলকিত করেছেন সাধারণ মানুষের মন। এরই মাঝে মুজিববর্ষ উপলক্ষে জাতির পিতার মোড়াল করার দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। তার কার্যালয়ের সামনেই গড়ে তুললেন জয় বাংলা চত্বর ও জাগ্রত জাতিসত্তা নামক ভাস্কর্য। জেলার প্রতিটি ভূমি অফিসের সামনে তৈরি করলেন জাতির পিতার প্রতিকৃতি যার নাম দিয়েছেন চিরঞ্জীব মুজিব৷
আমার ভাবনার জায়গা আরো বিস্তৃত হলো, মনে প্রশ্ন জাগলো একটা মানুষ এতোটা আগাগোড়া আদর্শের জায়গায় খাঁটি হয় কি করে। উত্তর পেয়ে গিয়েছিলাম নিজে নিজেই তাকে জানার আগ্রহ হলো তখন থেকেই। এটি রক্তের ঋণ। কারণ তার বাবা ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা কমিটির অন্যতম সদস্য এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম। এজন্যই হয়তো সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে আপোষহীন। বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণে তিনি আমার ওপর ভরসা রাখতে পেরেছিলেন সে বোধ আমার হৃদয়ে ও মননে আগামী দিনে ভালো কাজের প্রেরণা হয়ে থাকবে।
গেলোতো আমার আর মানুষটির পরিচয়ের কথা। এবার আর আমি তাকে নারী বলবো না। কারণ তিনি নিজেকে ছাপিয়ে গিয়েছেন, ছাড়িয়ে গিয়েছেন নারী সমাজকে। আমি বলবো তিনি একজন নির্মোহ ক্ষমতার অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে বেচে থাকা এক নান্দনিক মানুষ। মানুষ হয়ে জন্ম নিলেই মানুষ হওয়া যায় না। মানুষ হতে হলে প্রয়োজন মনুষ্যত্ব বোধ। তার ওপর যদি বলা হয় নান্দনিক মানুষ তাহলে তাকে গড়ে তুলতে হবে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে। শুধু নিজেকে নয়, সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করতে হবে তার পুরো সমাজের। আমি একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে এবং শিল্পীর চোখে নির্দ্বিধায় বলতে চাই সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন শুধু একজন নান্দনিক মানুষই নন, একজন নিখাদ শিল্পী ও শিল্পবোদ্ধা। কারণ তিনি শিল্প চর্চা করেন। শিল্পের লালন করেন। শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এখানে আমার দৃষ্টিতে তার এই উদারতার প্রতীকী তাৎপর্যকে আমি অন্যভাবে দেখি। একটি হলো মহান আল্লাহ প্রদত্ত তিনি একজন সুন্দর মানুষ। আর তার এই সৌন্দর্যের প্রভাব তার কাজের মধ্যে পড়ে। তাই তার কাজগুলো অন্য সবার চেয়ে আলাদা ও অনিন্দ্য সুন্দর। এভাবে যদি না হয় তাহলে দ্বিতীয়টি হলো, তিনি নন্দন চর্চা করেন, সুন্দর করে মানুষের মনে নাড়া দিয়ে কথা বলেন, নতুনত্বকে মেনে নেন অনায়াসে, নতুন নতুন সৃষ্টির সুখে তিনি হাসতে থাকেন। এইসবের প্রভাব তার মুখাবয়বে পড়ে তাই তিনি এতোটা উজ্জ্বল ও সুন্দর। আর তার হৃদয় ও সুন্দর অবয়বের আভা ললাট বাধে তার হাসিতে।
সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন এর হাসির মতোই মুক্তো দানা ঝরছে আমাদের সারা জেলা জুড়ে। আমার বিশ্বাস শুধু জন্মস্থান বি-বাড়িয়া অথবা কর্মস্থল নরসিংদী জেলা নয়, একদিন সমগ্র দেশ জুড়ে বহমান হবে তিনি শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতির যে নতুন অবয়ব সৃষ্টি করেছেন। সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন এর অবয়ব, তার হাসি সবকিছুই এক অনন্য সৃষ্টির মিছিল। এই হাসি লেগে থাকুক আমৃত্যু। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তার কর্মের আলো জ্বলবে যুগের পর যুগ। আমার এই সংগ্রামী আপোষহীন বোনকে জানাই লাল সালাম। স্যালুট। অনেক অনেক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং শুভকামনা।
লেখক: শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী
সম্পাদক, বাংলা দর্পণ
(দেশের ইতিহাসে প্রথম ও বঙ্গবন্ধুর সর্বোচ্চ তর্জনী ভাস্কর্য নির্মাতা)