ঢাকা, বুধবার, ৯ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৫শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রোজিনার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি সাংবাদিকদের

প্রথম আলোর সিনিয়র প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামের নিঃশর্ত মুক্তি এবং তাকে হেনস্তাকারী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চেয়েছেন সাংবাদিক নেতারা। তারা রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। অন্যথায় কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।

বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে ও এর বাইরে বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন আয়োজিত মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচিতে তারা এসব দাবি জানান ও হুঁশিয়ারি দেন।

প্রেসক্লাবের ভেতরে একযোগে আয়োজন করে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ), ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, বরিশাল ডিভিশনাল জানার্লিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, রংপুর বিভাগ সাংবাদিক সমিতি ও ফরিদপুর জার্নালিস্ট ফাউন্ডেশন।

অন্যদিকে প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণের বাইরে কর্মসূচি পালন করে বিএফইউজ ও ডিইউজের একাংশ এবং বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র। রোজিনা ইসলামের ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটিও প্রত্যাখ্যান করেন সাংবাদিক নেতারা। তারা রোজিনাকে কারাবন্দি করার ঘটনাকে মুক্ত গণমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপ বলে উল্লেখ করেন।

বিএফইউজে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আনা অভিযোগকে হাস্যকর, অবান্তর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করে। কাল রোজিনাকে জামিনে মুক্তি দেয়া, সাংবাদিক নেতাদের সমন্বয়ে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনার বিরুদ্ধে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করার দাবি জানায় সংগঠনটি।

এসব দাবি মেনে না নেয়া হলে দেশের সব গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের সব সংগঠন, সাংবাদিক ইউনিয়ন, প্রেসক্লাবসহ সাংবাদিকদের অন্য সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে সারা দেশের সাংবাদিক, শ্রমিক–কর্মচারীদের নিয়ে বিএফইউজে কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে বলে জানানো হয় কর্মসূচিতে।

রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপনের প্রতিবাদ জানিয়ে ডিইউজের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু বলেন, সরকারি অর্থায়নে কোনোভাবেই সাংবাদিকদের চরিত্র হনন করা যাবে না।

বিএসআরএফের সভাপতি তপন বিশ্বাস বলেন, রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কক্ষে আটক রাখার পর তারা দফায় দফায় কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার প্রস্তাব দেন। কিন্তু তাদের কোনো কথা না শুনে রোজিনাকে বিকেল চারটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত আটকে রাখা হয়। থানায় নিয়ে মামলা দেয়ার পর গতকাল কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলন করে তাদের সঙ্গে কথা বলতে চান। এ কারণে তারা ওই সংবাদ সম্মেলন বর্জন করেছেন।

কর্মসূচিতে বিএফইউজের সভাপতি মোল্লা জালাল, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আবদুল মজিদ, সহ-সভাপতি সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, সদস্য শেখ মামুনুর রশীদ ও সাবেক মহাসচিব আবদুল জলিল ভূঁইয়া, ডিইউজের সাবেক সভাপতি আবু জাফর সূর্য ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী, ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা ও সাধারণ সম্পাদক কাজল হাজরা, ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সভাপতি শারমীন রিনভী, এভিয়েশন অ্যান্ড ট্যুরিজম জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশের (এটিজেএফবি) সভাপতি নাদিরা কিরণ, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুনিমা সুলতানা, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক সমিতির সভাপতি নাসিমা আক্তার, বিএসআরএফের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান, বরিশাল ডিভিশনাল জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিন আল রশিদ, সাধারণ সম্পাদক মাহবুব সৈকতসহ অনেক সাংবাদিক নেতা।

এদিকে প্রেসক্লাবের বাইরে আয়োজিত কর্মসূচিতে রোজিনা ইসলামের সঙ্গে বিএফইউজের একাংশের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন গাজীসহ আটক সাংবাদিকদের মুক্তি দাবি করে সংগঠনটি।

রোজিনার মুক্তি চেয়ে বিএফইউজে ও প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ বলেন, রোজিনাকে যারা হয়রানি করেছেন, সরকার যেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়।

তিনি বলেন, এই সরকার মুক্ত সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে এবং দুর্নীতিবাজদের পক্ষে। এজন্য আমাদের সুস্থ সাংবাদিকতা পুনরুদ্ধার এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এর আগে সাগর-রুনি হত্যা মামলা বিচারের দাবিতে সাংবাদিকদের আন্দোলন কারো কারো বেঈমানির কারণে নস্যাৎ হয়ে গিয়েছিলো বলেও স্মরণ করিয়ে দেন তিনি।

রোজিনা ইসলাম দুর্নীতিবিরোধী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বংশীবাদক মন্তব্য করে শওকত মাহমুদ বলেন, রোজিনা ইসলাম সরকারের অনেক দুর্নীতি উন্মেচন করেছে। এজন্য তার ওপর সরকারের ক্ষোভ ছিলো। এজন্য তার কণ্ঠরোধ করার জন্যই তাকে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে এবং জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

সভাপতির বক্তব্যে কাদের গনি চৌধুরী বলেন, সাংবাদিকরা তথ্য চুরি করে না, তথ্য উদ্ধার করে। তথ্য লুকিয়ে রাখে দুর্নীতিবাজ ও লুটেরারা। তাই এই সরকারকে বিদায় না জানালে সাংবাদিক নির্যাতন বন্ধ হবে না। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রোজিনা ইসলাম এবং সাংবাদিক নেতা রুহুল আমিন গাজীসহ কারাবন্দি সকল সাংবাদিকের মুক্তি দেয়ার জন্য আহ্বান জানান তিনি।

ডিইউজের সভাপতি কাদের গনি চৌধুরীর সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বিএফইউজের মহাসচিব নুরুল আমিন রোকন, সাবেক মহাসচিব এম এ আজিজ, সাবেক সভাপতি কবি আবদুল হাই শিকদার, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান, ডিইউজের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম, সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাকের হোসাইন, জাহাঙ্গীর আলম প্রধান, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, ইআরএফ সভাপতি শারমিন রিনভী, বিএফইউজের সহ সভাপতি মোদাব্বের হোসেন, ডিইউজের সহ-সভাপতি শাহীন হাসনাত ও রাশেদুল হক, সাংবাদিক নেতা আমীরুল ইসলাম কাগজী, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সভাপতি রফিকুল ইসলাম আজাদ, বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা, সাব এডিটর কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসান হৃদয়, কারা নির্যাতিত ফটো সাংবদিক শফিকুল ইসলাম কাজল, ডিইউজের দফতর সম্পাদক ডি এম আমিরুল ইসলাম অমর, সাংবাদিক নেতা সাখাওয়াত হোসেন ইবনে মঈন চৌধুরী বক্তব্যে বক্তব্যে রাখেন। এছাড়া মানবন্ধনে সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিযার ইশরাক হোসেন।

অন্যদিকে রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সমাবেশে করেছে ডিআরইউ। রোজিনার নিঃশর্ত মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালানোর ঘোষণা দেন ডিআরইউর সভাপতি মোরসালীন নোমানী। তিনি বলেন, রোজিনা ইসলামকে প্রায় ৬ ঘণ্টা আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে এবং হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি প্রসঙ্গে মোরসালীন নোমানী বলেন, যারা নির্যাতন করেছেন, তাদের দিয়েই কমিটি করা হয়েছে। তিনি এই কমিটি প্রত্যাখ্যান করে বিচার বিভাগীয় কমিটি গঠনের দাবি জানান। তিনি বলেন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা থামিয়ে দেয়া হলে সরকারই দুর্বল হয়ে পড়বে।

রোজিনা ইসলামের মুক্তির দাবিতে পাশে থাকার জন্য সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক। তিনি রোজিনার নিঃশর্ত মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বলেন, রোজিনার ওপর জুলুমকারীদের বিচার চাই, শাস্তি চাই। মুক্ত সাংবাদিকতায় বাধা যত কালাকানুন আছে, সব বাতিল চাই।

সমাবেশে জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ থাকার বিষয়ে জোর দেন। তিনি বলেন, প্রশাসন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়েছে। আগে সাংবাদিক নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটলেও কোনো বিচার হয়নি। রোজিনা ইসলামের জামিন ও মামলা প্রত্যাহার না হলে লাগাতার আন্দোলন চলবে।

ডিআরইউর সাধারণ সম্পাদক মসিউর রহমান খানের সমাবেশের সঞ্চালনায় সমাবেশে জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, সিনিয়র সাংবাদিক জাকারিয়া কাজল, ডিআরইউর সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম, সাবেক সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ চৌধুরী ও সাবেক সহসভাপতি আজমল হক, ডিআরইউর সহসভাপতি ওসমান গণি, ডিরেক্টরস গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান সাগর, ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন আরিফ, টিআরঅ্যান্ডবি সভাপতি রাশেদ মেহেদী, ল রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি মাশহুদুল হক, ইআরএফের সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল হাসান, বিএফইউজের নেতা শেখ মামুনুর রশীদ, অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড ট্যুরিজম জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশের সভাপতি নাদিরা কিরণ, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের নাদিয়া শারমিন, বরিশাল ডিভিশনাল জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিন আল রশিদ, ঢাকার শরীয়তপুর সাংবাদিক সমিতির মোজাম্মেল হক প্রমুখ বক্তব্যে রাখেন।